১ম থেকে ৫ম শ্রেণির জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১ বাংলা বিষয়ের আবশ্যকীয় শিখনক্রম।
Views

১ম থেকে ৫ম শ্রেণির জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১ বাংলা বিষয়ের আবশ্যকীয় শিখনক্রম।
ভূমিকা
শিশুর মনন জগতের বিকাশ ও পরিপুষ্টি সাধনে মাতৃভাষার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশু মাতৃভাষার মাধ্যমেই চারপাশকে চিনতে শেখে- যোগাযোগ স্থাপন করে, স্বপ্ন দেখে, চিন্তা করে; এমনকি নিজের দেহ-মনকে পরিচালনা করে।
শিশু জন্মের পর যে ভাষাপরিবেশে বড় হয় সে ভাষাই শিশু প্রাকৃতিকভাবে আয়ত্ত করতে থাকে। পারিবারিক ও অনানুষ্ঠানিক পরিবেশে শেখা ভাষা বিদ্যায়তনের আনুষ্ঠানিক পরিবেশে প্রমিত (Standardized) হয়; যে ভাষার মাধ্যমে শিশু মূলত বৃহত্তর সমাজ তথা রাষ্ট্রের সাথে মিথষ্ক্রিয়া সাধন করে।
বিদ্যালয়ে মাতৃভাষা শিক্ষার আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো শিশু বিদ্যালয়ে নিজের পারিবারিক-অনানুষ্ঠানিক ভাষাকে শুধু প্রমিতই করে না, এ ভাষার মাধ্যমে অন্যান্য পাঠ্য বিষয়েও জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করে। সুতরাং বিদ্যায়তনিক পরিবেশে মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম । কেননা শিশু বিদ্যালয়ে মাতৃভাষা শিখনে দুর্বল হলে তারপক্ষে অন্যান্য বিষয়েও জ্ঞান দক্ষতা অর্জন দুরূহ হয়ে পড়ে।
শিশুকে মাতৃভাষা সঠিকভাবে শেখানোর মাধ্যমে তাকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে পারঙ্গম করে তোলা বিদ্যায়তনিক পরিবেশে মাতৃভাষা শিখন শেখানোর অন্যতম লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সুসংগঠিতভাবে মাতৃভাষা শেখানোর পরিকল্পনার একটি পরিকল্পনাছক হচ্ছে মাতৃভাষা বিষয়ক শিক্ষাক্রম।
মাতৃভাষা শিক্ষাক্রমের এ পরিকল্পনায় প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ভাষা আয়ত্তকরণ ও ব্যবহারের সর্বশেষ তথ্য ও তত্ত্বগুলোর সমন্বয় করা হয়েছে। মাতৃভাষা শিখন শেখানোর বাংলা অঞ্চলের মদনমোহন-বিদ্যাসাগর- রবীন্দ্রনাথ অনুসৃত নীতি যেমন বিবেচনায় নেয়া হয়েছে তেমনি প্রতীচ্যের গঠনবাদ (Constructivism)-কেও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সমন্বিত কৌশল নেয়া হয়েছে। এ হিসেবে ভাষাশিক্ষায় বাক্য-শব্দ-বর্ণক্রম পদ্ধতি যেমন ব্যবহার করা হয়েছে তেমনি বর্ণ-শব্দ-বাক্যক্রমও ব্যবহার করা হয়েছে।
পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম (Revised Curriculum)-এ ভাষার গঠনগত দিক শনাক্তকরণ;দৈনন্দিন জীবনে, বর্ণনা ও তথ্যপ্রদানে, ভাব প্রকাশে, যোগাযোগ স্থাপনে ভাষা ব্যবহারে শিক্ষার্থীকে দক্ষ করে তোলাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অন্তিমে সৃজনশীলতা বিকাশে ভাষাকে শিক্ষার্থীর কাছে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে তুলে দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ভাষার চারটি দক্ষতার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে শোনা ও বলা দক্ষতার কম চর্চা হয়েছে। এ শিক্ষাক্রমে প্রথম শ্রেণি থেকেই এ দুটো দক্ষতার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ শিক্ষাক্রমে ভাষার গঠন বৈশিষ্ট্যের ধ্বনি সচেতনাকেও (Phonological awareness ) বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন গবেষণা ও প্রতিবেদনে পড়া দক্ষতার যে দুর্বলতার চিত্র ধরা পড়েছে সে কারণে পড়ার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নানা বাড়তি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পড়তে শেখা (Learn to read) ও পড়ে শেখার (Read toLearn) পরিসর সৃষ্টি করা হয়েছে। বলাবাহুল্য ভাষার চারটি দক্ষতাই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
মাতৃভাষার এ শিক্ষাক্রম প্রণয়নকালে আশা করা হয়েছে শিশুকে অনুশীলনীমূলক কাজের ভেতর দিয়ে যতদূর সম্ভব অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে ভাষার দক্ষতাসমূহ অর্জনে পারঙ্গম করে তোলা হবে। ভাষা শিখন শেখানোর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত উপকরণসমূহ যথাসম্ভব বাস্তব ও কর্মোপোযোগী হবে।
শিক্ষাক্রমটিকে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও কর্মতৎপরতাভিত্তিক করা হয়েছে। শিখন শেখানোর ও মূল্যায়নের নির্দেশনাসমূহ যথাসম্ভব বিস্তারিতভাবে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রাথমিক পর্যায়ের এ শিক্ষাক্রমের ভেতর দিয়ে শিশুর যেমন ভাষার প্রাথমিক ভিত তৈরি হবে তেমনি পরবর্তী ধাপেও গমন করতে পারবে।
ভাষা শিখন ও শিক্ষণের ক্ষেত্রে একীভূতকরণের ধারণাকে বিশেষভাবে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এ কারণে শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য অডিও-ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট প্রদর্শনের মাধ্যমে বর্ণ, শব্দ, বাক্য প্রভৃতি শেখানোর উদ্যোগ সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল উপকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। শারীরিক প্রতিবন্দ্বীদের মধ্যে যাদের লিখন ক্ষমতা নেই তারা উচ্চারণের মাধ্যমে শব্দ, বাক্যের কাঠামো বুঝতে পারবে। তাছাড়া বর্ণের ব্লক দিয়ে লেখার অনুশীলন করানোর বিবেচনা রাখা হয়েছে। কনটেন্টসমূহকে জেন্ডার সংবেদনশীলভাবে উপস্থাপনা নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ভিন্ন ভাষাভাষী শিশুরা বাংলা শব্দ ও বাক্যকাঠামোর সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, সংবিধানের নীতি, বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার, জাতীয় শিক্ষানীতির অগ্রাধিকারসমূহেকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এছাড়া এ শিক্ষাক্রমে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যসমূহ (Sustainable Development Goals) এবং বিশ্বনাগরিকতার(Global Citizenship) গুণাবলির ধারণাসমূহ সমন্বয় করা হয়েছে। করোনা উত্তর নতুন বাস্তবতায় শিক্ষণের ক্ষেত্রে সর্বত্র সংমিশ্র শিখন (Blended Learning) পদ্ধতি ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।
এ শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে পাঠ্যপুস্তকসহ অন্যান্য শিক্ষা-উপকরণ উন্নয়ন করা হবে এবং ভাষা শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে- শিক্ষাক্রম কমিটির এটি গভীর প্রত্যাশা।

No comments
Your opinion here...